“বল বীর – বল উন্নত মম শির!” – কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইনটি তার অদম্য আত্মবিশ্বাস এবং সংগ্রামী মনোভাবের এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম এবং মানবতার সপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জৈষ্ঠ্য ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনে নানা রকমের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। মাত্র কিশোর বয়সে পিতৃহীন হয়ে, পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে জীবিকার তাগিদে রুটি বিক্রি থেকে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করাসহ নানা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁর লেখনিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। শৈশব থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁকে ভবিষ্যতের সংগ্রামী নজরুল হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
নজরুলের সাহিত্যকর্মে দেশপ্রেম, সাম্যবাদ, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানুষের মুক্তির প্রতি গভীর ভালবাসার প্রকাশ পাওয়া যায়। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’তে তিনি বলেন, “আমি চির-বিদ্রোহী বীর – আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির !” এই লাইনগুলি তাঁকে বাংলার বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত দিয়েছে। তাঁর লেখায় তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন এবং যেকোনো ধরনের অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা শুধু সাহিত্যকর্ম নয়, বরং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার ছিল। তাঁর ‘চল চল চল’ গানটি স্বাধীনতা সংগ্রামের মিছিলে প্রাণের সঞ্চার তৈরি করেছিল। নজরুলের রচিত অসংখ্য গান আজও বাংলার সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। ‘আমি গান গাই যে দিন’, ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’, ‘শিকল পরা-ছল’ প্রভৃতি গান ও কবিতা মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে যুগ যুগ ধরে।
নজরুলের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপ। ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন, যেখানে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন এবং তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু তবুও তাঁর সংগ্রামী মনোবলকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। কারাগারে বসেও তিনি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, যা আজও প্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
তাঁর সাহিত্যকর্ম, গান এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সবই তাঁকে একটি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম আজও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তাঁর লেখা ও আদর্শ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
আজ ২৪ মে, আমাদের প্রিয় বিদ্রোহী কবির জন্মদিন। কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন আমাদের মুক্তির পথপ্রদর্শক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক মহামানব। তাঁর অমর সৃষ্টি এবং দেশপ্রেমের চেতনা আমাদের চিরকাল অনুপ্রেরণা যোগাবে।তাঁর বিদ্রোহী চেতনা, মানবতার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শ আমাদেরকে সবসময় পথ দেখাবে। আজকের এই বিশেষ দিনে, আমরা তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সমাজকে আরও উন্নত ও মানবিক করার শপথ নিই।শুভ জন্মদিন, প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম! আপনার আদর্শ এবং আপনার রচিত গান, কবিতা, সাহিত্য আমাদের হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।
আঃ হাকিম
People reacted to this story.
Show comments Hide commentsবেশ, ভালো হয়েছে।
❤️