‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে’
অনবদ্য এই পঙক্তি বিংশ শতাব্দির অন্যতম পরাবাস্তব আর উত্তর আধুনিক ধারার বাঙ্গালি কবি জীবনানন্দ দাশ-এর। তিনি স্কুল জীবনেই বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি শুরু করেন। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে জীবনানন্দ অগ্রগণ্য। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী কবি ও লেখকের জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাকে বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি কিংবদন্তি এই কবির জন্মদিন।
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের এই দিনে বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনা নিবাসী। তাঁর মা কবি কুসুম কুমারী দাশ ও পিতা সত্যনানন্দ দাশ। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে নিবাস স্থানান্তরিত করেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন।
১৯৫৪ সালে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। ‘শ্রী ‘কাল পুরুষ’ তাঁর ছদ্মনাম।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- ঝরা পালক (প্রকাশের কাল ১৯২৭) ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন-(১৯৪২)। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতা সমূহ পরবর্তীতে কবিতা গ্রন্থ মহাপৃথিবী (১৯৪৪) এ প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮)। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
কবির মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো প্রকাশিত রূপসী বাংলা (১৯৫৭) এবং ১৯৬১ তে প্রকাশিত হয় বেলা অবেল কালবেলা। তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো- সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম তোমার কথা ভেবে (১৯৯৮) অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)।
ইংরেজি ছাড়াও ফরাসিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় অজস্র গল্প ও উপন্যাস। এগুলোর প্রথম সংকলন জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২)। বেশ কিছুকাল পর প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯)। পরবর্তীকালে আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী প্রকাশ করেন ১৯৮৬ সালে। ১০১টি চিঠির সংকলন জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র প্রকাশিত হয় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে।
কবি লিখেছিলেন-
‘পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৫ সালে ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এর আগে, ১৯৫২ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। বিশ্ব কাব্যসাহিত্যের অসাধারণ মেধাবী এই বাঙালি কবি কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
The post কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন আজ appeared first on সার সমাচার.
কোন মন্তব্য নেই
মন্তব্য করুন Cancel